হরপ্পা সভ্যতার অধিবাসীদের সামাজিক জীবন সম্পর্কে আলোচনা করো | Whats are the characteristics of Harappa/Indus vally civilisation
আজকের
আলোচনার বিষয় হল হরপ্পা বা সিন্ধু সভ্যতার মানুষজন দের সামাজিক, অর্থনৈতিক
জীবন সম্পর্কে । নীচে বিস্তারিত আলোচনা করা হল এই সম্পর্কে
- শ্রেণী বৈষম্য
শ্রেণী শোষণ
খাদ্য
পোষাক-পরিচ্ছদ ও অলংকার
গৃহস্থালির সরঞ্জাম
অবসর বিনোদন
সিলমোহর
লিপি
সমাজে নারীর স্থান
হরপ্পা সভ্যতা হলো ভারতের প্রাচীনতম নগরকেন্দ্রিক সভ্যতা। তাম্র প্রস্তর যুগে বিকাশ লাভ করা এই সভ্যতার বিভিন্ন
কেন্দ্রে খননকার্যের ফলে প্রাপ্ত গৃহস্থালির দ্রব্যাদি, পোশাক-পরিচ্ছদ,
খাদ্য, অবসর বিনোদনের উপাদান, লিপি, সিলমোহর প্রভৃতি থেকে এই সভ্যতার
অধিবাসীদের সামাজিক অবস্থা সম্পর্কে আভাস পাওয়া যায়। নিম্নে হরপ্পা
সভ্যতার অধিবাসীদের সামাজিক অবস্থা সম্পর্কে আলোচনা করা হলো।
১)শ্রেণী বৈষম্য-হরপ্পা
ও মহেঞ্জোদারোর নগর বিন্যাস তথা দুর্গ ও নগরের পাশাপাশি ঝুপড়ি জাতীয়
সারিবদ্ধ ছোট বাড়ির অবস্থান, সমাধির প্রকারভেদ থেকে অনুমান করা হয় হরপ্পা
সভ্যতার সমাজের শ্রেণী বৈষম্য ছিল।সমাজে
সম্ভবত তিন শ্রেণীর মানুষ বসবাস করতেন-প্রথম শ্রেণীতে ছিলেন পুরোহিতরা বা
উচ্চবিত্ত, দ্বিতীয় শ্রেণীতে ছিলেন ধনী, বণিক, বুর্জোয়া, কারিগর ও
যোদ্ধারা বা মধ্যবিত্ত এবং তৃতীয় শ্রেণীতে ছিলেন দরিদ্র
কৃষক ও শ্রমিকেরা। ঐতিহাসিক মাটি মার হুইলারের মতে উচ্চবিত্ত বা পুরোহিত
শ্রেণী ছিলেন শাসকগোষ্ঠীর মানুষ। ঐতিহাসিক এ.এল.বাসাম মনে করেন হরপ্পা
সভ্যতার সমাজে মধ্যবিত্ত মানুষের সংখ্যা বেশি ছিল। ঐতিহাসিক এ.ডি. পুসলকর
অবশ্য হরপ্পা সভ্যতার জনসমাজকে শিক্ষিত, যোদ্ধা, বণিক এবং কর্মকার ও
শ্রমিক- চারটি শ্রেণীতে বিভক্ত করেছেন।
২)শ্রেণী শোষণ-ঐতিহাসিক
মার্টিমার হুইলার, গর্ডন চাইল্ড, ডি.এন.ঝা প্রমূখ মনে করেন হরপ্পা সভ্যতার
সমাজের প্রথম শ্রেণি অর্থাৎ উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর দ্বারা নিম্ন
শ্রেণীর মানুষ শোষিত হতো।নিম্ন শ্রেণীর মানুষেরা সমাজের পরিশ্রমসাধ্য
কাজগুলি তথা চাষবাস, শস্য ঝাড়াই, বোঝা বহন, পয়ঃপ্রণালী পরিষ্কার ইত্যাদি
কাজ গুলি করতেন এবং নগর দুর্গের বাইরে ছোট ছোট বাড়িতে বসবাস করতেন।
ঐতিহাসিক ডি.এন.ঝা এর মতে এই সভ্যতার সমাজের দরিদ্র শ্রেণীর মানুষেরা
দুকামরা বিশিষ্ট বাড়িগুলিতে থাকতেন। শস্যাগারের অস্তিত্ব থেকে অনুমান করা
হয় উদ্বৃত্ত খাদ্যে উৎপাদনকারীদের তথা সমাজের নিম্ন শ্রেণীর মানুষদের
অধিকার ছিল না। ঐতিহাসিক গর্ডন চাইল্ড এর মতে দুর্লভ তামার তৈরি অস্ত্রের
দ্বারা হরপ্পা সভ্যতার শাসকেরা সমাজের অন্যান্য লোকেদের দমিয়ে রাখতে এবং
শহরের চারপাশের জমিতে কৃষকদের ভূমিদাসে পরিণত করতো।
৩)খাদ্য-হরপ্পা
সভ্যতার অধিবাসীদের প্রধান খাদ্যশস্য ছিল গম ও যব। এছাড়া তারা দুধ,
খেজুর, রাই, মটর, বাদাম, শাকসবজি ইত্যাদিকেও খাদ্য হিসাবে গ্রহণ করত।
রংপুরে ও লোথালে প্রাপ্ত ধানের নিদর্শন থেকে মনে করা হয় এই সভ্যতার
অধিবাসীরা খাদ্য হিসাবে ভাতের ব্যবহারও জানত। শুধুমাত্র নিরামিষ খাদ্যই
নয়, এই সভ্যতার অধিবাসীরা আমিষ খাদ্য হিসাবে মাছ, ডিম ও বিভিন্ন পশু পাখির
মাংস গ্রহণ করত।
৪)পোষাক-পরিচ্ছদ ও অলংকার-হরপ্পা
সভ্যতার বিভিন্ন কেন্দ্রে প্রাপ্ত মূর্তিগুলি থেকে এই সভ্যতার অধিবাসীদের
পোষাক-পরিচ্ছদ ও অলংকার সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। নারী ও পুরুষের পোষাকে
বিশেষ কোনো পার্থক্য ছিল না, উভয়েই ওপরের অংশটা শালের মতো এবং নিচের
অংশটা ধুতির মত দেখতে পোষাক পরিধান করতো। পোষাক তৈরীর জন্য সুতি ও পশম
ব্যবহার। এই সভ্যতায় নারী-পুরুষ উভয়েই বিভিন্ন রকমের আংটি, গলার হার,
কঙ্কন ইত্যাদি অলংকার ব্যবহার করত। অলংকার নির্মাণে সোনা, রুপোসহ অন্যান্য
মূল্যবান ধাতু ও বিভিন্ন দামি পাথর ব্যবহার করা হতো।এই
সভ্যতার গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র চানহুদারো ও হরপ্পায় খনন কার্য চালিয়ে
প্রাপ্ত তথ্য থেকে ঐতিহাসিকরা অনুমান করেন যে এই সভ্যতার মহিলারা আধুনিক
যুগের মহিলাদের মত লিপস্টিক, নেলপালিশ, ভ্যানিটি ব্যাগ, আয়না, চিরুনি
ইত্যাদি ব্যবহার করত।
৫)গৃহস্থালির সরঞ্জাম-হরপ্পা
সভ্যতার বিভিন্ন কেন্দ্র বিভিন্ন গৃহস্থালির সরঞ্জাম তথা থালা, বাটি, জগ,
কাঁচি, সূচ, ক্ষুর, খাট, চেয়ার, টুল, মাদুর ইত্যাদি আবিষ্কৃত হয়েছে। এই
সমস্ত দ্রব্যাদি ছাড়াও এই সভ্যতার বিভিন্ন কেন্দ্রে কুঠার, ছোরা, তীর ধনুক
ইত্যাদি অস্ত্রশস্ত্র নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে। এই সমস্ত গৃহস্থালির
সরঞ্জাম ও অস্ত্রশস্ত্র নির্মাণে মাটি, পাথর, কাঠ, তামা ও ব্রোঞ্জ ব্যবহার
করা হতো।
৬)অবসর বিনোদন-হরপ্পা
সভ্যতার বিভিন্ন কেন্দ্রে প্রাপ্ত বিভিন্ন উপকরণ থেকে হরপ্পা সভ্যতার
অধিবাসীদের অবসর বিনোদন তথা আমোদ-প্রমোদ সম্পর্কে জানা যায়। এই সভ্যতার
সাধারণ মানুষের আমোদ-প্রমোদের মাধ্যম পাশা খেলা, পশু শিকার, ষাঁড়ের লড়াই,
মাছ ধরা, রথ চালানো ইত্যাদি। এই সভ্যতার শিশুরা খেলনা গাড়ি, পুতুল,
ঝুমঝুমি ইত্যাদি ব্যবহার করত। এই সভ্যতার বিভিন্ন কেন্দ্র প্রাপ্ত অর্ধনগ্ন
নারী মূর্তিগুলির শৈল্পিক দেহভঙ্গিমা দেখে মনে করা হয় যে এই সভ্যতায়
অবসর বিনোদনের মাধ্যম হিসাবে নৃত্য-গীতেরও প্রচলন ছিল।
৭)সিলমোহর-হরপ্পা
সভ্যতার অধিবাসীরা ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য সিলমোহর ব্যবহার করত। এই সভ্যতার
বিভিন্ন কেন্দ্রে অন্তত 2000 সিলমোহর পাওয়া গেছে। ভারতের বাইরে সুসা ও
মেসোপটেমিয়াতেও হরপ্পার সিলমোহর আবিষ্কৃত হয়েছে। এই সিলমোহরগুলি তামা,
ব্রোঞ্জ ও পোড়ামাটি ব্যবহার করা হতো।
৮)লিপি-হরপ্পা
সভ্যতার বিভিন্ন কেন্দ্রে প্রাপ্ত সিলমোহরগুলিতে বিভিন্ন চিত্রলিপি
উৎকীর্ণ রয়েছে, যা সিন্ধু লিপি নামে পরিচিত। এই লিপিগুলিতে মোট 270 টি
অক্ষর আবিষ্কৃত হয়েছে। এই লিপিগুলি দেখতে প্রাচীন সুমেরীয় হায়ারোগ্লিফিক
লিপির মতো। আজ পর্যন্ত এই লিপির পাঠোদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।
৯)সমাজে নারীর স্থান-হরপ্পা
সভ্যতার সমাজ ছিল মাতৃতান্ত্রিক। এই সভ্যতার বিভিন্ন কেন্দ্রে প্রাপ্ত
অর্ধনগ্ন নারীমূর্তিগুলি দেখে ঐতিহাসিকরা অনুমান করেন যে এই সভ্যতায়
নারীরা যথেষ্ট স্বাধীনতা ভোগ করতো এবং দেবী মূর্তিপূজার প্রচলন থেকে অনুমান
করা হয় এই সভ্যতায় নারীদের বিশেষ সম্মান ছিল।
0 মন্তব্যসমূহ